
তোমারে যা দিয়াছিনু সে তোমারি দান
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়
হে বন্ধু বিদায়।”(শেষের কবিতা)
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার সর্বশেষ চরণে ভালোবাসায় কবিঋণের কথা উপলব্ধিজাত!প্রেম-ভালোবাসায় সর্বদা পূর্ণতা অপূর্ণতা বিরাজমান থাকে। কেউ হারিয়ে কাঁদে কেউ পেয়ে মূল্য দেয় না। ভালবাসার কাঙ্গাল আমরা সকলেই। প্রেমিক প্রেমিকার সুন্দর মুহূর্তগুলো কবি পারে তার কাব্যচর্চার জীবন্ত রাখতে। কবিতা সম্পর্কে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন,poetry is the powerful spontaneous overflow of powerful feeling. আর এই শক্তিমান অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত উৎসার জন্ম নেয় শান্ত, স্মৃতিবাহিত আবেগের মধ্য থেকে’from emotion recollected in tramquality.
অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ এ প্রকিশত কবি মামুন চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
তাঁর জন্ম ৩০ মে ১৯৮২সালে। তিনি সাতক্ষীরা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ঝিনাইদহ কেসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান থেকে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি দেশের সফল বিতার্কিক ছিলেন। স্বাধীনভাবে বিতর্ক চর্চা করার শিক্ষা দিয়েছেন। স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের রাস্ট্রায়ত্ত বানিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সিনিয়র প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত।
আমি কবির ‘প্রগাঢ় ও ভালবাসার গল্পো’- পাঠ করার আত্মোপলব্ধি প্রকাশ করার ক্ষুদ্র চেষ্টা। এই কাব্যগ্রন্থের সর্বমোট ৫২ টি কবিতা রয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন নৈঋতা ক্যাফে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা প্রগাঢ় ভালবাসার গল্পে কবি বলেছেন,
“তোমার জানা দরকার
ভালোবাসা কতটা প্রলয়ংকারী হতে পারে।
প্রবল ঝড়ের আগে
থমথমে আকাশ হতে পারে,
সুনামির চেয়েও বড় জলোচ্ছ্বাস
ভূমিকম্প হতে পারে।
চুলের খোঁপা,চোখের কাজল
ঠোঁটে লিপস্টিক বিধ্বংসী হতে পারে।”
প্রেম বার্তায় ভালোবাসার আত্মপ্রকাশ করেছেন।প্রেমিকার অনুপস্থিতিতে কবি মনে কতটা কলরব সৃষ্টি করে তা জানান দেয়! কবি কী করছেন তাঁর প্রতিটি মুহূর্তে প্রিয় তোমার জন্য আত্মচিৎকার। তার কানে কি আদৌ পৌঁছায়। সে কি জানে নাকি না জানার ভান করে। ভালোবাসা মানে না কোন বাঁধা, মানে না কোন নিয়ম। প্রেম-ভালোবাসা নিজস্ব অবয়বে গঠিত। যেখানে নাই অন্য কোন কিছুর আধিপত্য। প্রেম-ভালোবাসার সাম্রাজ্যে প্রেমিক-প্রেমিকাই যেন অধিপতি। প্রেমের টানে প্রেমিকযুগল চলছে তো চলছেই।
প্রগাঢ় ভালবাসার গল্পো কবিতার শেষ চরণে তা প্রতীয়মানঃ
“ভালোবাসা কতটা গভীর, গাঢ় হতে পারে,
ভালোবাসা কতটা নিশ্চিত হতে পারে,
জীবনভর দূর থেকে
একাকী ভালবাসতে পারে!”
কবি মামুন চৌধুরীর ‘আনন্দকাব্য’ কবিতায় প্রেমিকযুগলের বিষণ্নতাকে দুর্বিপাকের শোকে মেশাতে চেয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস না পারার ক্ষোভ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আনন্দকে আলিঙ্গন করে বাঁচতে বলেছেন।
“একটা আনন্দের কবিতা হোক,
আমাদের যত বিষন্নতা
মিশে যাক দুর্বিপাকের শোক,
আজ না হয়
একটা আনন্দের কবিতা হোক। “
‘রং বিন্যাস’ -কবিতায় কবি বলেছেন-
“কে বলে কবিতার রং হয় না?
রঙ্গিন সাদাকালো স্বপ্নেরা
কবিতার রঙে রঙিন।
মাঝে মাঝে নীল আকাশ হয়ে যায়। “
-রংহীন ধূসর কালো স্বপ্নেরা রংধনুর মতো আকাশ রঙিন করে। কবিতাকে রাঙ্গিয়ে তুলে! কবিতার সাথে কবি নিজ জীবনকেও রাঙিয়ে তুলেন।মানুষের জীবনকেও রাঙিয়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
‘রাবণের চিঠি’ -কবিতায় রাবণের প্রেম বার্তাকে কবি প্রকাশ করেছেন গভীর ভাবে,
“আজ রণে যাচ্ছি
নিশ্চিত ফিরবো না জেনেই
কিন্তু জেনে রেখো,
কোন ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই।
ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। “
-যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে রাবণ সীতাকে ভালবেসে চিঠি লেখে, তেমন কবি মামুন চৌধুরী ও লিখেছেন,যুদ্ধে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যায়। তবুও সীতার ভালোবাসার জন্য বাঁচিয়ে রাখে রাবণকে। ক্ষোভহীন, অভিমানহীন ভালোবাসা রাবণের আমৃত্যু জারি থাকবে! তেমন কবি মনে ও ভালোবাসা আমৃত্যু থাকবে!
‘কাপালিক’ কবিতায় কবি বলেছেন-
“যেন শূন্যতা আর
শূন্যতার বুকটাকে যত্ন করে করে ধরে রাখা
জেনো আমার মত, পাবোনা জেনেও হাত ধরে,
মুখোমুখি বসে থাকা। “
এই কবিতায় কবি শুণ্যতায় – হতাশায় তাঁর প্রেমিকার সামনে মুখোমুখি বসিয়ে রাখে!হতাশা শূণ্যতা বিদীর্ণ করে দুজন মুখোমুখি বসে থাকে!হতাশা প্রত্যাশাই রূপান্তর ঘটিয়েছেন।
না পাওয়ার বেদনা কে আগলে রেখে মানুষ বাঁচতে জানে ভালোবাসতে জানে। প্রেমকে জীবিত রাখতে জানে।
‘ক্ষতিপূরণ’ কবিতায় –
“কেন করেছি কোন ভুল
এইতো ব্যাঘাত মানছি, কান মলছি
ভুল হয়েছে ভুল।
জীবনে সবকিছুর ক্ষতিপূরণ পূর্ণ হয়না। জীবনের ক্ষতিপূরণে কবি নিজের ভুলকে নান্দনিক চরণে উপস্থাপন করেছেন। কবি বুকের প্রলয়-নাচন থামানোর জন্য কেউ নেই। আছে প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রত্যাশা।
‘রূপকথা’ কবিতায় –
“একদিন সূর্য
ভালোবেসে চাঁদকে প্রশ্ন করল
কী চাও আমার কাছে?
চাঁদ বলল –
সারাজীবন ভালোবাসার আলোয়
আলোকিত থাকতে চাই।”
সূর্য চাঁদ কে ভালবেসে আলোর ভাগ দিল। নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও ভালোবেসে গেল চাঁদকেই!
“ক্রমশ প্রকাশ্য “কবিতায় –
প্রেমিকাকে বলেছেন,
“মহাশয়া
ভালোবাসা প্রকাশ করার শক্ত। “
-ভালোবাসার প্রকাশ সরাসরি করতে হবে এমন তো কোন কথা নয়। ভালোবাসাকে যত্ন করতে হয় বুকের মধ্যে, এক সমুদ্র আবেগ জমা রাখতে হয়, যা ক্রমশ প্রকাশ্য কবিতায় কবিও তাই প্রকাশ করেছেন!
“গদ্য কথা” -কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“সম্পর্ক খুব কঠিন জিনিস
ধ্রুব বলে কিছুই নেই
প্রয়োজনের তাগিদে জন্ম নেয়। “-
প্রয়োজনের তাগিদে, সময় এর উপস্থিতিতে, মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। যাপিত জীবনের সম্পর্কগুলো নানানভাবে তৈরি হয়।
‘গদ্য কথা’- কবিতায় ভালোবাসা নিয়ে বলেছেন,
“ভালোবাসা আরো আপেক্ষিক
টিকিয়ে রাখতে অনেক
কাঠখড় পোড়াতে হয়। “
কবি মনে করেন, ভালোবাসা আপেক্ষিক। ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ‘কোন এক কফি সন্ধ্যায়’কবিতায়-
“আমাকে দেখো বা না দেখো
আমার কিন্তু দারুণ লাগে,
আমার সামনে তুমি
আমার কাছে তুমি
হৃদয়ের পাশে তুমি।”
-প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকুক বা না থাকুক নিয়ম করে অনুরণন ঘটায়। হৃদয় জানান দেয় দুজন পাশাপাশি অবস্থান করে!
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; কবি হৃদয়ের কল্পনা -চিন্তা ও অভিজ্ঞতার কথা কবিতায় -ভাষায় ফুটিয়ে তোলাই হল কবির সার্থকতা। জগতের রূপ-রস-শব্দ -ঘ্রাণ যখন কবিমনের কল্পনায় জারিত হয় তখনই কবিতার জন্ম হয়।সৃজনী আত্মার ছন্দোবদ্ধতায় প্রকাশ পায় তাঁর কাব্যিকতার দৃষ্টি প্রেক্ষাপট।কবির ক্ষেত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে সন্ধান করতে হয় প্রকৃতি-সত্য -সুন্দর -আবেগ ও আনন্দের।বাস্তবজ্ঞানকে কাব্যিক রূপে উপস্থাপন করা কবির প্রকাশভঙ্গির উন্মোচিত দিকদর্শন।কবি তাঁর কল্পনার অভিব্যক্তিকে শব্দের সংমিশ্রণে নান্দনিক করে তোলে!যা প্রগাঢ় ভালোবাসা কবি মামুন চৌধুরী করতে পেরেছেন।কবি কবিতার ভাষায় প্রগাঢ় ভালোবাসা-প্রেম- আবেগ-নিমোর্হ ভাবকল্পনা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। না পাওয়ার বেদনাকে আনন্দে রূপ দিয়েছে।কবিতায় শব্দ ব্যবহারে কবি সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।কারণ কবিতায় শব্দ ব্যবহার হল কবিতার মৌলিক উপাদান।মানুষের জীবনে প্রেম যেনো সবসময় আনন্দের সঙ্গী হয়ে উঠে,বিরহের ব্যথাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনকে চালিত করতে পারে তার বার্তা সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।সামগ্রিকতায় শুধু থাকবে ভালোবাসার গভীরতা উদারতা তাহলেই না পাওয়ার বেদনায় কেউ ভেঙে পরবে না, দুঃখ পাবে না। জীবন নতুন করে গড়ে করবে। আলোয় আলোয় রঙিয়ে তুলবে।’প্রগাঢ় ভালোবাসার গল্পো’- হয়ে উঠেছে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের আনন্দ বার্তা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা ‘যেমন কাব্যগ্রন্থ নয় উপন্যাস। তেমিন ‘গ্রগাঢ় ভালোবাসার গল্পো ‘গল্পগ্রন্থ নয় কাব্যগ্রন্থ!কবির কাব্যগ্রন্থের নামকরণের দিক থেকে কতোটা নান্দনিক তা পাঠক বইটি প্রথমে হাতে নিলেই বুঝতে পারবে।সবশেষে কবি মামুন চৌধুরী ব্যস্ততা উতরে কাব্যচর্চায় নিজেকে রাঙিয়ে তুলুক, সে প্রত্যাশা করছি।
রত্না মাহমুদা
কবি ও গবেষক