ঐতিহাসিক সত্যের ধারা অনুসরণ করলে মানতেই হবে আদি কবি বাল্মিকী প্রথম প্রতিবাদের শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন। সূচনা পর্ব থেকে চর্যাপদ যেমন প্রতিবাদী ভাষা অভিনব কবি ভাষা তেমনি উচ্চারণের কাছে নিজ নিজ সাধনা সিদ্ধি গোপন রাখার চেষ্টা ছিল। মানুষের দিন যাপনের যাত্রা নানাভাবে কবিরা ফুটিয়ে তুলেছেন।

শব্দ ও অর্থের সহযোগে মানব মনের ভাব কল্পনা যখন অনুভূতি রঞ্জিত যথাবিহিত শব্দ বিন্যাসে তথা অর্থ ব্যঞ্জনায় রূপ পরিগ্রহ করে তখন আমরা তাকে কবিতা বলি। কল্পনার প্রাচুর্য আবেগমন্ডিত ভাষা ছন্দময়তা ইত্যাদি কবিতার উপাদান বলে গণ্য হল কবিতা সনাক্তকরণে এগুলোই চূড়ান্ত নয় ধাতু দুর্লভ নয় যেখানে কবিতা রই লক্ষণ সমূহ সহজে নজরে আসে অন্য পক্ষে কবিকল্পনার বিস্তার ও মাধুর্য আবেগে রাভুক্ত ছন্দের কারিগরি কবিতার জন্ম অসম্ভব। যুক্তিবাদী উপাধি দর্শন এবং নিউটনীয় বিজ্ঞান প্রভাবিত অষ্টাদশ শতকের বাস্তুতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এই কল্পনা ছিল ঐন্দ্রজালিক সৃজন ক্ষমতা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু জগতে সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে রহস্যি কিরণময় উপলব্ধি জন লোকের দর্শন ভাব নেয় মানববন্ধনের কাগজের মত যার উপর ছাপ পড়ত ইন্দ্রিয় লব্ধ প্রতিচ্ছবি সমূহের। কবিতাকে মনে করা হতো বৌদ্ধিক সরলতা তথা উইট এর চর্চা।

কিছু কি কল্পনাকে ছাড়িয়ে এবং বাস্তবতায় যখন মানুষের আগমন ঘটে আধুনিক কালে। বিদ্রোহ বিপ্লব সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কার্যকর্মে কি কবিতার কোন ভূমিকা বা অবদান আছে কিনা তারই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন কবি নাফিউল ইসলাম নাফি।

বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজেকে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত থেকেছেন।বাংলা ও ইংরেজি দুভাষাতেই  তার কাব্যগ্রন্থ  রয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এ তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ কর্কট প্রকাশিত হয় জিনিয়াস পাবলিকেশন থেকে। কাব্যগ্রন্থটির জিনিয়াস পাবলিকেশনের তিন নাম্বার প্যাভিলিয়নে।

কবির প্রেম, কবির প্রতিবাদ  শব্দের গাঁথুনিতে প্রতিয়মান হয়! বর্তমান সমাজের বাস্তব-সত্য ঘটনাগুলো তার কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পায়। তিনি এত তো মানুষের ভিড়ে সত্যিকারের অর্থের দেশ প্রেমিক মানুষগুলোকে খুঁজে বের করার। প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের মানুষের কাছে, যারা কিনা নিজেদের স্বার্থকে কি করার প্রচেষ্টায় সফল।

কর্কট কবিতাটি পড়লে দেখা যায় ছলে বলে কৌশলে মানুষ এর চোরাবালিতে বন্দি করার প্রতিচিত্র।বলা হয়ে থাকে বিবেকহীন মানুষ পশুর তুল্য।বর্তমান সময়ে বিবেকের জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। অন্যের উপকারের কথা ভাবেই না। মানবমনের শুদ্ধতায় ছেয়ে গেছে বিবেকহীন মানুষের স্বার্থান্বেষী আগ্রাসনে!বিবেকের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে মানব মন।

“ছলে বলে কৌশলে

কি যে কি করে তলে তলে

তলে  তলে অপকৌশলে

লোভের চোরাবালিতে আটকালে ডুবে যায় বিবেকহীন লোনা জলে

ফলে,  একে স্বার্থপর বাঁচা বলে ধনসম্পদ টানে নিজের আগলে বিবেকটা  যায় গলে

ফলে বিবেক জলাঞ্জলি হয় লোভের লোনা জলে।”

বিবেকের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরে। বিভৎসতাকে ফুর্তি বলে রংমহলকে আনন্দ বলে,  কৌশলে ধর্মকে অস্বীকার করে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হওয়ার প্রচেষ্টায় মগ্ন আমরা!

বিবেকের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও নিজেদের বিজয়ী বলে পরিচয় দেয়!বিভৎস অর্জনকে  ফূর্তি বলে জয় জয় বলে সম্পদের পাহাড় গড়ছে! তবুও হীনমন্যতায় ভুগছে না।সবকিছু রসাতলে যাওয়ার পরও নিজেদের অর্জনকে প্রকৃত অর্জন বলে জানান দেয়।

“এ যাতা কলে লুট কে বিজয় বলে

বিভসৎতাকে ফুর্তি বলে, রংমহলে

আনন্দ মানেই ফুর্তি নানা ছলে।

ধর্মকে পাঠা বলে, বলে –

এতে লোলুপ পুলকতা যায় রসাতলে

অঢেল ডালা সম্পদ যায় বিফলে।”

অতিচালাকের গলায় দড়ি। অতিচাক হলে আমের সঙ্গে ছালাও যায়। জীবনপথ হয় ফুটবলের মত। কিক মেরে  যেমন এর পা থেকে ওর পায়ে  বল ছুঁড়ে!!  ঠিক তেমন হয় এই মানুষগুলোর জীবনদশা। কবি তাঁরই বাস্তবতাকে উন্মোচন করার প্রয়াস করেছেন। কবি এত বছর চাকরি জীবনে দেখেছেন কত শত মানুষের মুখ ও মুখোশের প্রকৃত রূপ।

“লোকে বলে অতি চালাক হলে

আমাছলা যখন যায় জ্বলে

জীবনের দশা হয় ফুটবলে

তখনও যদি তাকায় কবরের অতলে

তবুও চলে।”

একবার ধরা খেলে আবার ছলেবলে কৌশলে সেই কুৎসিত অর্জনের পেছনেই ছুটতে থাকে। মনে রাখার বালাই তাঁদের না।

“কিন্তু আবার ছলে বলে

কুৎসিত  অর্জন যেন আসে দলে দলে।

হাইপারটেনশন ছাড়ে অযাচার সুইমিংপুলে

পেরেশানি  তবু মেটেনা স্বাদ দুধেও ঘোলে।

কেউ বলে বা না বলে তলে তলে।

ফলে, তখন বাতাস নড়ে ক্ষমতাসক্তির কলে।

ও কাজের এই কর্কট সময়কালে।”

কবি গোল্ডফিস কবিতায় বলেছেন বিবেকের হাতছানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আবার সে নেশা সস্তা অর্জন। যেন বেখেয়ালি পথভ্রষ্ট এক উন্মাদের আচরণ! স্বাভাবিক মানুষ হয়েও নেই তাঁরা স্বাভাবিক। মানুষ হয়েও জীবনখাতায় নাম লেখায় অমানুষ নামক অপবাদে। অপমান শাস্তিকে তোয়াক্কা না করে চলতে থাকে আপনমনে! কবি এখানে সেলফিস কে ব্যঙ্গার্থক শব্দে গোল্ডফিস বলেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে সেলফিসের চেয়েও আরও নিকৃষ্ট এই গোল্ডফিস।

“বিবেকের টোকাকে বানিয়ে বোকা

ও কাজের রেশ মিলিয়ে যায় নিমেষ

ভুলে গিয়ে ঝড়ঝরে তরতরে ফ্রেশ।

দায়ে দায়িত্ব শেষ!

চৈতন্যে বৈকল্যের শিস

ইশ! জেনে শুনে এ বিষ!

ভুলে গেলেই ঝুলে যায়

মামলা ঢিসমিস

ইশ!

মুক্ত একুরিয়ামে বদ্ধ গোল্ডফি ”

চামাচামির ব্যঙ্গ নাম দিয়ে  কবি মৌচামচামি রেখেছেন। মৌ যেমন মধু এনে মৌচাকে সংগ্রহ করে। মৌচামচামির দলও নিজেদেরকে মৌমাছির মত সুন্দর আগামী গড়ার, শর্টকাট আয় করার পথ লুফে নিয়েছে। তাই কবি এঁদের মৌচামচামি বলে আখ্যায়িত করেছেন।

“মৌ চামচামি,

চামচামি এখন সবচেয়ে দামি

উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুন্দর আগামী

চামচামির উজ্জ্বল আলো

চামচামির ভবিষ্যৎ ভালো

চামচামিতে আয় উন্নতি।”

সবগুলো কবিতা থেকে এই কবিতাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। বর্তমান সময়ের প্রকৃত সত্যকে তিনি প্রতিবিম্বিত করার চেষ্টা করেছেন।যার কাঁধে দেশের দায়িত্ব, সমাজের সুষ্ঠুতার দায়িত্ব, এত এত দায়িত্বের ভীড়েও তার কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রতিবাদের ভাষা! শব্দের গাথুঁনি, বাক্যের অভিনব কৌশলে কর্কট হয়ে উঠেছে এক নান্দনিক কাব্যভাষ্য! কবিতায় বাঁচুন, কবিতায় থাকুন। আপনার কাব্যচর্চা জারি থাকুক কবি। আপনার কাব্যআবেগকে আমি সাধুবাদ জানাই।

রত্না মাহমুদা
কবি ও গবেষক
২৭.০২.২০২৪