আহা জামি ভাই, চোখের মাঝে ভেসে উঠলো ২০ বছরের কত স্মৃতি - রাষ্ট্রীয় ব্লগ | রাষ্ট্রীয় ব্লগ | জাতীয় ও মানবিক ঐক্যপ্রয়াস
  • নাগরিক সাংবাদিকতা

    আহা জামি ভাই, চোখের মাঝে ভেসে উঠলো ২০ বছরের কত স্মৃতি

      প্রতিনিধি ৯ মার্চ ২০২৩ , ১০:০২:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ

    রিয়াজ উদ্দিন জামি,এই নামটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমার হাইস্কুল জীবনে। বাবার প্রিয় পত্রিকা দৈনিক জনকন্ঠ পড়ার সূত্র ধরে। আমার শিক্ষক বাবা প্রতিদিন স্কুল থেকে জনকন্ঠ পত্রিকাটি বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সেই থেকেই আমার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে কোন বিশেষ সংবাদ ছাপা হলে চোখ পড়তো রিয়াজ উদ্দিন জামি নামটির দিকে। আখাউড়ার একটি গ্রামে থাকি বলে তখনো জামি ভাইকে স্বশরীরে চিনি না আমি।

    একদিন জনকন্ঠ পড়ে মনটি ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে সময়কার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি’র কোন এক নেতার বিরুদ্ধে (নামটি এখন মনে নেই) সংবাদ প্রকাশ করায় তার উপর হামলা হয়। এই নিয়ে পরবর্তী কয়েকদিন যে ফলোআপ রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল সেগুলোও আমি পড়েছি। ক্ষমতাসীন দলের নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ লেখার কারণে কিংবা এভাবে যদি বলি, স্রোতের বিপরীতে কলম ধরেছিলেন বলেই একজন সংবাদদাতা হিসেবে তিনি আমার প্রিয় হয়ে উঠেন। সম্ভবত প্রিয় হয়ে উঠার কারণেই মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার একটা ইচ্ছা ছিল আমার। সেই ছোট্ট বয়স, তাছাড়া গ্রামে থাকি বলে সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি।

    আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর থেকেই পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের বন্ধু সাহেদ হোসেনের Md Shahid Hossain হাত ধরে প্রথমে স্থানীয় একটি পত্রিকায় এবং পরবর্তীতে প্রথম আলো বন্ধুসভায় যোগদানের মাধ্যমে প্রতি বুধবারে প্রকাশিত বন্ধুসভার পাতায় লিখতাম।

    ওই যে স্কুল জীবনে রিয়াজ উদ্দিন জামির সঙ্গে পরিচয়ের ইচ্ছে ছিল। একদিন তৎকালীন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের পরীক্ষা করতে নিয়ে গিয়ে সাহেদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল জামি ভাইয়ের সঙ্গে। এখনো মনে আছে- আমি যখন উনাকে বলেছিলাম যে, আমি দৈনিক জনকণ্ঠ পড়ার মাধ্যমে আপনার নাম অনেকদিন ধরে জানি, তিনি তখন আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। পরে সাহেদ আমার নামটি জামি ভাইকে বলার পর তিনি স্থানীয় দৈনিক তিতাসকণ্ঠে প্রকাশিত আমার কয়েকটি সিরিজ রিপোর্টের প্রশংসা করেছিলেন। সিরিজ রিপোর্টগুলো ছিল– ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি নিয়ে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার লেখার হাত ভালো। ভালো করে লেখাপড়া করো, সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা থাকলে পড়ালেখা শেষ করার পর করবে।’ আমি সে সময় জামি ভাইয়ের কাছে ওনার ফোন নম্বর চেয়েছিলাম। উনি নম্বরটি বলার পর আমার প্র্যাকটিক্যাল খাতার মলাটে লিখে রেখেছিলাম।

    এরপর মাঝে মাঝে নিউজ-ভ্যালু আছে আমার এলাকার এমন সব বিষয় জানাতে জামি ভাইকে মোবাইল টু মোবাইলের দোকান থেকে ফোন দিতাম। এরই মধ্যে আমি দৈনিক প্রথম আলোর সেই সময়কার প্রতিনিধি ওয়ালিদ সিকদার রবিন ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। যেই মানুষটির (রবিন ভাই) সান্নিধ্য না পেলে আমি তৈরী হয়ে উঠতে পারতাম না বরং ঝরে পড়তাম। সেই রবিন ভাইয়ের গল্প আরেকদিন অন্য কোন লেখায় বলবো।

    রবিন ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে জামি ভাই, বিজন ভাই, পীযুষ দা, বাপ্পী দা, নূর ভাই ও মনির ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। আমি যে সময়কার কথা বলছি, সেই সময়ে সাদা কাগজে হাতে লিখে ফ্যাক্সের মাধ্যমে সংবাদ পাঠানো লাগতো। আমার হাতের লেখা সুন্দর জেনে জামি ভাই একদিন আমাকে টি. এ রোডস্থ ডেলটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। ড্রয়ার থেকে অফসেট পেপার বের করে আমার হাতে দিলেন।ছোট ছোট বাক্যে বলতে শুরু করলেন সংবাদের ইন্ট্রো, ইন্ট্রোর বিস্তার ও উদ্ধৃতি। এক পৃষ্ঠায় ছোট করে অনেকগুলো লেখা লিখতে পারতাম বলে জামি ভাই আমার লেখা পছন্দ করতেন। দৈনন্দিন ঘটনাসহ ছোটখাট সংবাদ এক পৃষ্ঠায় শেষ করা মানে ফ্যাক্সের খরচ বেঁচে যাওয়া।

    মনে আছে, জামি ভাই জীবনের প্রথম আমাকে দিয়ে যেই প্রতিবেদনটি লিখিয়েছিলেন সেটি ছিল– শহরের উত্তর মৌড়াইল এলাকায় অনুমোদনহীন ভাবে গড়ে ওঠা শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা নিয়ে। পরদিন জনকন্ঠের ব্যাক পেজে সংবাদটি ছাপা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের টনক নড়ে। পরে অবশ্য তারা এই শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এই অভিযানটি নিজের চোখে দেখেছি বলে জামি ভাইয়ের সঙ্গে লেখায় সঙ্গ দিতে আমারও ভালো লাগে। ইমেইলের যুগ চলে আসার আগ পর্যন্ত এভাবে জামি ভাইয়ের সঙ্গে কত পৃষ্ঠা যে লিখেছি তার কোন হিসেব নেই। জামি ভাইয়ের তৈরি বিভিন্ন কনটেন্টের ‘শ্রুতিলেখক’ হতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম সংবাদ লেখায় জাতি ও লিঙ্গবৈষম্যমূলক এবং যৌন উদ্দীপক শব্দের ব্যবহার করা যায় না। এছাড়াও আরো কত কিছু যে শিখেছি। জামি ভাই ও বাপ্পি দা’র সহযোগিতায় জীবনের প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় নিউজ নেটওয়ার্ক কর্তৃক পরিচালিত সংবাদ বিষয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

    জামি ভাই প্রায়ই বলতেন লিখতে গেলে উনার হাত ব্যথা করে। এজন্য একটানা বেশিক্ষণ লিখতে পারতেন না তিনি। পরবর্তীতে কম্পিউটার টাইপিং এর যুগ চলে আসায় সেই ঝক্কি থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

    গত ছয় মাস ধরে জামি ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। ব্রেইন ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। নিয়মিত কেমোথেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সাংবাদিকতা থেকে বিরতি না নেওয়া মাত্র ৫০ বছর বয়সী এই মানুষটি গত সোমবার রাতে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। সব বন্ধন খুলে দিয়ে চলে গেলেন জনমের তরে। আমি দু:সংবাদটা পাই মধ্যরাতে এবং যারপর নাই আমি শোকে হিম হয়ে যাই। জামি ভাইয়ের মহাযাত্রায় আমি স্তব্ধ, শোকবিহব্বল। তার সঙ্গে আমাদের সকল সহকর্মীদের কত, কত যে স্মৃতি! এই স্মৃতিগুলো এখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

    নিশ্চয় পরপারে ভালো থাকবেন জামি ভাই।

    —-মাসুক হৃদয়, দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ