প্রতিনিধি ৫ অক্টোবর ২০২৪ , ৬:০৮:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ
অধ্যক্ষ কামরুল হাসান সোহাগঃ
শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়,একটি মহান ব্রত।শিক্ষকরা জাতি গড়ার নিপুন কারিগর,জাতির সূর্য্য সন্তান ও জাতির বিবেক খ্যাত।একটি জাতির টেকসই ভিত্তি, সমৃদ্ধি,জাতির আচার-আচরণ নির্ভর করে সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার উপর।জাপানে শিক্ষকরা কোন অভিযুক্ত হলেও উচ্চ আদালতে কাঠগড়ায় চেয়ারে বসিয়ে তা়দের বিচারকার্য সম্পাদন করেন।পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়,ব্যতিক্রম কেবলই বাংলাদেশে।
পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ,যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা ননএমপিও,এমপিও,সরকারী,বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত নানাবিধ পর্যায়ে বিভক্ত।দেশের প্রায় ৯৭% শিক্ষার্থী বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে,মাত্র ৩% সরকারী প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেন।সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে শিক্ষা উপকরণে বৈষম্য।শিক্ষকরা শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার নন,সামাজিকভাবেও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।বাংলাদেশে শিক্ষকদের নিয়োগ,পদোন্নতি,উচ্চতর স্কেল থেকে শুরু করে সবকিছু বিবেচ্য হয় রাজনৈতিকভাবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক গনমাধ্যমে আফসোস করে বলেছেন যে তাঁর সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি হয়না অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ার অপরাধে।রাজনীতি করলেও আবার ক্ষমতার পালাবদলে হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বানিয়ে দেন, ক্ষুদ সরকারই তাঁদেরকে।শিক্ষকরা থাকবে শিক্ষা কার্যক্রমে,গবেষনায়।তা না করে ত্রুটিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার জন্য তাঁদেরকে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিতে বাধ্য হয়েই সম্পৃক্ত হতে হয়।অনেক শিক্ষকই আর্থিক অনটনে ভোগে নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে নিজেকে জড়ায় আর্থিক অনিয়মে।দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী মানবেতর জীবন অতিবাহিত করেন ননএমপিও শিক্ষকগণ।তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযত হলেও বেতন বিহীন থাকতে হয় যুগের পর যুগ।।বেতন বিহীন শিক্ষক হওয়ার ফলে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য পেশায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে প্রচেষ্টা চালাই অনেকে,ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।আবার নানাবিধ সুযোগ সুবিধা যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়,তাই এ সকল সুযোগ সুবিধা লাভের জন্যই শিক্ষকদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়।দেশের নানাবিধ অসঙ্গতি দুরীভূত করতে হলে সবার আগে শিক্ষা ব্যবস্থার এই সীমাহীন বৈষম্যের অবসান জরুরী।আপনি লিচু গাছ রোপণ করে আঙ্গুর ফল প্রত্যাশা করা যেমন বোকামী,তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য দূর না করে শিক্ষকদের কাছ থেকে সমৃদ্ধ শিক্ষা চাওয়া একই কথা।বৈষম্যের স্বীকার কেবলই বেসরকারী শিক্ষকরাই হচ্ছে এমনটি নয়।দেশের অসাধারণ শিক্ষক বলা হয় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের,সেখানেও অন্তহীন বৈষম্য।
একজন সরকারী কলেজের সর্বোচ্চ পদোন্নতি হচ্ছে অধ্যাপক পদ,যা ৪র্থ গ্রেডে স্কেল দেওয়া হয়।হাতে গোনা ২/১ একজন শিক্ষক অধ্যাপক পদ পেয়ে ১ম গ্রেডে যুক্ত হয়েছেন।যে কারণে সম্প্রতি ১০ জন শিক্ষক শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে চাকুরী নিয়েছেন।২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দুরীভূত করতেই আম-জনতা আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে অর্থবহ করতে হলে,সর্বাগ্রে শিক্ষা ক্ষেত্রের বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।এই লক্ষে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে।এই কমিশনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম শিক্ষকদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি মুক্ত করতে হবে।সম্পূর্ন রাজনৈতিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ বন্ধ করে, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানতে হবে।মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানতে হলে, তাঁদেরকে যেকোন পেশার তুলনায় অধিক আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে হবে শিক্ষা উপকরণসমুহ।বাড়াতে হবে গবেষনার ক্ষেত্র।শিক্ষার প্রতিটি স্তরে কারিগরী শিক্ষাকে বাধ্যতামলক করাও জরুরী।শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার বিধি/বিধান তৈরী করতে হবে।শিক্ষার সকল পর্যায় বন্ধ করে কেবল জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অর্থাৎ এক দেশ এক নীতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।শিক্ষা সেক্টরের বৈষম্যগুলো স্থায়ীভাবে দুরীভূত না করলে,কোন সেক্টরেই বৈষম্য দুরীভূত হবেনা।
লেখক ও গবেষক:
অধ্যক্ষ কামরুল হাসান সোহাগ
পূর্বাঞ্চল কলেজ, বিজয়নগর।
তারিখ:৫ অক্টোবর ২০২৪