তাসফির ফেরা-ওমায়ের আহমেদ শাওন - রাষ্ট্রীয় ব্লগ | রাষ্ট্রীয় ব্লগ | জাতীয় ও মানবিক ঐক্যপ্রয়াস
  • ধর্ম ও জীবন

    তাসফির ফেরা-ওমায়ের আহমেদ শাওন

      প্রতিনিধি ২ মে ২০২৩ , ৩:১৩:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

    রাষ্ট্রীয় ব্লগ রিপোর্টঃ 
    দোতলা বাসার ব্যালকোনিতে বসে থাকলে প্রকৃতির এক নিবিড় ঘনিষ্ঠতা পর্যবেক্ষণ করা যায়-। আর সেটাতে যদি দখিনা সমীরণের হু-হু করা শব্দের সাথে রাত্রির জোছনার অপরূপ আলো যখন মিশিয়ে যায় সর্বত্র তখন অন্যরকম অনুভূতি সঞ্চারিত হয় যেন জীবনের সর্বস্ব কিছু জুড়ে !
    তখন মধ্যরাত। চারপাশ স্তব্ধ ! সুনসান নিরবতা স্বত্ত্বেও তাসফিয়াহ্ তাসফি চেয়ারে বসে গালে হাত রেখে প্রেমের শেষ হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো গভীরভাবে ভাবতে থাকে। ভেতরের রুম থেকে ভেসে আসা ‘বুকেরও ভেতরে রাখিব তোমারে…’ গানটির চরণ শোনা যায়। হঠাৎ পাশে রক্ষিত টেবিলে রাখা সেলফোনটা বেজে ওঠে।
    সে হাতে নিয়ে দেখে সজল একটা মেসেজ পাঠিয়েছে- ‘তুমি যতটা কষ্ট নিতে পারবে, আমি অবশ্যই তার থেকে বেশী কষ্ট তোমাকে কখনোই দেবনা। ভালবাসলে কাঁদতে হয়-! এটা তো তোমার কাছ থেকেই শিখেছি ! তাই তোমার প্রতি আমার আর কোন ধরণের চাহিদা নেই; এজন্য তোমাকে ভালবাসার প্রয়োজন বোধও করছি না।’ তাসফি মেসেজটি পড়া শেষ করে দু’চোখ বন্ধ করে একটু ভেবে নেয়। তারপর নিজেকে সামাল দিতে না পেরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগে। হয়ত সে কান্না রূপময়ী রজনীর অমোঘ জোছনায় বিলীন হয়ে যায় !
    পরদিন কলেজের বিস্তীর্ণ মাঠে তাসফি একাকী বসে ফোনে মেসেজ লিখছে। ইতিমধ্যে বান্ধবী তারিন এসে পিছনে দাঁড়ায়। তাসফিকে ডাকনাম ধরে ডেকে বলে- এই তাজ-! এখানে বসে বসে সারাদিন মোবাইলে মেসেজ লিখছিস আর ঐদিকে সজল তার সাথে তোর পিক, ভিডিও যেসব আছে; সবকিছু ভাইরাল করছে-।
    – মানে-? কি বলছিস, তারিন-? ও আমার সাথে ব্রেক করছে- ! তাই বলে এতোবড় ক্ষতি তো আর করতে পারেনা-!
    ও না তোকে খুব ভালবাসে বলেছিলি ! সেই ভালবাসা এখন গেল কই-?
    তারিনের কথা শুনে তাসফি কোন প্রকার কথার উত্তর না দিয়ে কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে- হয়ত অতি বিশ্বাসী মানুষেরা যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন নিশ্চুপ থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।
    তারিন তাসফিকে চুপ থাকা দেখে আবারো বলে, কিরে এখানে বসে না থেকে ওর কাছে দোষ স্বীকার করে নে-! যা হয়েছে, হয়েছে- ওকে বুঝিয়ে দ্রুত বিয়ে করে ফেল- নাহলে সমাজের মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারবি না।
    – কি আর করবো বল- যে যেতে চায় তাকে ধরে রাখার সাধ্য যে আমার নেই। তাকে আমার মন, দেহ সবকিছুই দিয়ে দিয়েছি ! আর সে আজ এমন করলো-! কিভাবে পারলো সে আমার মত বাপমরা মেয়েকে আঘাত দিয়ে। আমি যে আঘাত সইতে পারিনা। রাতের পর রাত যার সাথে ফোনে কথা বলেছি, যেখানে যখন ইচ্ছা সে ডেকে- বলে ক্রন্দনের সূত্রপাত ঘটায়।
    কপাল-! এইজন্য তোকে আগেই বলেছিলাম- যত সম্পর্কই হোক ছেলেদের সাথে অবাধে মেশা উচিত নয়। তুই আমার কথা না শুনে বলেছিলি যে, আমি তোর ভালো দেখতে পারিনা। তোর সাথে হিংসা করি। জেনে রাখিস, সব মেয়েরা বান্ধবীদের সাথে হিংসা করেনা। আর আমি তো সজলকে লাইক করিনা, তাহলে কিভাবে ভাবলি- আমি তোর কাছ থেকে সজলকে কেড়ে নিব।
    – দুনিয়াতে যে এতো খারাপ মানুষ আছে- যার বিবেক নাই- যে প্রকৃত ভালবাসাকে মেনে নিতে চায় না। বল তারিন, আমি তার জন্য কি করি নাই-? সে আজ আমাকে এইভাবে প্রতিদান দিল-?
    অদ্যকালে তাসফির চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটিল- যে আজিবন ভালবাসার জন্য ভালবাসে তাকেই ভালবাসা উচিত।
    সন্ধাকালে তাসফি নিজ বাসাতে পৌছালে ভাই, বোনদের মানসিক অত্যাচারে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়; যদি এমন কেউ পৃথিবীতে থেকে থাকে যে মন-প্রাণ উজাড় করে সারজীবন পাশে থেকে সুখ-দুঃখের সমব্যথী হয়ে ভালবেসে যাবে। পৃথিবীতে কেউ কখনো একা নয়। কেউ না কেউ কারো প্রেমে পড়েই, কেউ না কেউ কাউকে ভালবাসেই। নিজের জীবনের ওপর স্বচ্ছ বিশ্বাস রেখেই আত্মহুতি দিতে পারলো না।
    একদিন তাসফির প্রচন্ড জ্বর আসে। সে জ্বরের প্রকোপে আধমরা প্রায়। আচমকা ফোনটা ঝাপসা চোখে দেখতে লাগে। অচেনা এক নাম্বার থেকে কল আসে- অপরদিক থেকে একজন কে বলারটি পর্যন্ত সুযোগ না দিয়ে বলে- ‘আমি শাওন। আমার বিশ্বাস আপনি এখন কারো সাথে রিলেশন করেন না। তাই আমি যদি আপনাকে প্রোপোজ করি চাইলে অবশ্য না করতে পারবেন না। কারণ আমার বিশ্বাস মন থেকে চাইলে অনেককিছুই পাওয়া সম্ভব। আপনাকে আমি মন থেকে, মাইন্ড থেকে, হৃদয় থেকে, হিয়া থেকে, অন্তকরণ থেকে, চিত্ত থেকে, দেহ থেকে, আত্মা থেকে, আমার সর্বস্ব কিছু থেকে ভালবাসতে চাই ! আজিবন আপনার একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই। চাইলে আপনি আমার প্রস্তাব গ্রহন করতে পারেন আর চাইলে নাও গ্রহন করতে পারেন। যদি না গ্রহন করেন তাহলে বুঝবো আপনি অতি আপন একজনকে জীবন থেকে হারালেন; যে আপনাকে জীবনের মতই ভালবাসে।’
    – প্রেমের ডায়ালগ বলা শিখছেন নাকি-?
    সবকিছুকে হেলা করে মিথ্যা ভাবতে নেই।
    – ও-! তাই বুঝি। তাহলে ট্রাই করে দেখি-!
    এরপর থেকেই শাওনের সাথে গভীর রিলেশন গড়ে ওঠে তাসফির। দিন-রাত সকল ভাবনাকে ঠেলে তাদের গভীরতা বাড়তে লাগে। দু’জনের প্রথম দেখা হয়- রংপুর চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে। তাসফি শাওনকে একটি গোলাপ ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
    এই প্রথম আমি কাউকে প্রোপোজ করছি-! আশা করি, আমাকে কখনো আঘাত দিবেন না। আমায় ছেড়ে যাবেন না-। বলেন- আঘাত দিবেন না- আপনি শপথ করেন-!
    এটা আমার জীবনেরও প্রথম ভালবাসা। আর প্রথম ভালবাসাকে কেউ হারাতে চায় না।
    বেশ কিছুদিন পর। শাওন তাসফিকে প্রমাণ করে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে তার ওপর সন্দেহ পোষণ করে। ছেলেরা যখন এড়িয়ে যেতে শুরু করে মেয়েদের ভালবাসা তখন তরতর করে বেড়ে ওঠে। ঠিক তেমনি- তাসফি শাওনের সাথে সম্পর্ক টিকে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
    একদিন সকালবেলা শাওন তাসফিকে তার বোনের বাসায় নিয়ে গিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে শারিরীক ব্যবহার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অবশ্য তাসফির বিরূপ মনভাবে বিরত হয়। সেদিনই তাসফি শাওনকে এই বলে চলে যায়- তোমার সাথে আমার রিলেশন রাখা আর কোনদিনও সম্ভব নয়, এর কারণ একদিন তুমি বুঝতে পারবে। শাওন তাসফির নিকট হতে এমন বৈপরীত্য মনোভাব দেখে রীতিমত হতাশায় নিমজ্জিত হয়। সে বুঝতে পারে, যারা ভালবাসাকে অবহেলা করে তারাই একসময় ভালবাসার জন্য কাঁদে। তাসফি ও শাওনের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
    কিন্তু শাওন কোনভাবেই তাসফিকে ভুলতে পারেনা। কারণ, মন থেকে যদি কাউকে একবার ভালবাসা যায় তাহলে কোনভাবেই ভোলা যায় না। মেয়েদের কাছে আবেগ বেশী দেখালে তারা পাত্তা দিতে চায়না। তেমনি তাসফি শাওনের কোন প্রকার আবেগ, কথা, চাওয়ার আকুতি প্রভৃতি কোন কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করেনা। তাসফি শাওনকে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে, আমি তো তোমার কখনো ছিলাম না। এতদিন যা কিছু তোমার আমার মাঝে ঘটে গেছে; তা তো ছিল তোমার ফল। আমার সাথে বাজী ধরে রিলেশন করার ফল এবার তোমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমি প্রথম থেকেই সজলকে ভালবাসতাম আর আজিবন ভালবেসে যাবো। আর এতে যদি আমাকে কোনভাবে বিরক্ত করো তাহলে তোমার কপালে শনির দশা ঘটবে। শাওন নিজের ভুল বুঝতে পেরে; তাসফিকে অতি আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে-। অন্যদিকে তাসফি আবারো অন্য কারো সাথে রিলেশন করতে শুরু করে-। কোন মেয়ে যদি একবার প্রেমে আবদ্ধ হয় তবে তা থেকে আর কখনো বের হতে পারবে না।
    তিন বছর কেটে যায়। শাওন তবুও তাসফিকে ভুলতে পারেনি। হঠাৎ একদিন তাসফিকে মনে পড়ে যায়। শাওন ঢাকা ছেড়ে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কেন জানি খুব মনে পড়ছে তার। গভীর রাত্রের কালো অন্ধকারকে উপেক্ষা করে বাস ছুটে চলছে। আর  শাওনের বক্ষে একটি কথাই বারবার কম্পন করে- ‘এই প্রথম আমি কাউকে প্রোপোজ করছি-! আশা করি, আমাকে কখনো আঘাত দিবেন না। আমায় ছেড়ে যাবেন না-। বলেন- আঘাত দিবেন না- আপনি শপথ করেন-!’ শাওনের কান্না পেয়ে বসে। তাসফির কথা ভাবতে ভাবতে সকাল গড়িয়ে যায়। বাস থেকে নেমে পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়াতেই একটি পাগল টাইপ লোক এসে বলে-
    তাসফিকে খুঁজছেন-? ওতো জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত-! মেডিক্যালের দুই নম্বর বিল্ডিং -এর তিন নম্বর ওয়ার্ডে আছে-! যান- দ্রুত যান-!
    শাওন পাগলের মত ছুটে যায় তাসফির কাছে। তাসফি বেডের ওপর শুয়ে আছে। নির্বাক চোখে শাওনকে দেখে জল গড়িয়ে পড়ছে। তাসফি ঈশারায় একখানা চিঠি নিতে বলে-। শাওন তা নিয়ে পড়তে লাগে-।
    ‘অনেক ভেবে দেখলাম যে, তোমার মত নিঃস্বার্থভাবে কেউ আমাকে লাভ করেনা। আমি তোমার জীবনে ফিরে আসতে চাই- তুমি কি বলো-?’
    তোমার নাম্বার অফ কেনো জানপাখি-? জানো, আমার বিশ্বাস ছিল- একদিন তুমি আমাকে বুঝবেই- আমি যাই কিছু করি; তোমাকে কখনো মিথ্যা বলিনি। তোমাকে কত ফোন দিয়েছি- আমি সবকিছুই জানি- তারপরও তোমাকে গ্রহন করতে চেয়েছি। ভালবাসা কোন শর্ত দিয়ে হয়না। তুমি কতভাবে আমার কাছে টাকা নিয়েছো। কই-? আমিতো কিছু মনে করিনি। ভালবাসা হলো- মনের ব্যাপার, দু’জনের আত্মা এক হয়ে কাছে থাকার প্রচন্ড আকাঙ্খার ব্যাপার। আমি তো দেহজ প্রেম চাইনি। আসলে তোমাকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম; তুমি আমাকে সত্যি ভালবাসো কিনা ?
    তাসফি ক্ষীণ গলায় বলে- ‘শাওন, আমি সবসময়ই তোমাকে শুধু ভালবাসতাম। আসলে আজকের এ পরিণতি হলো, তোমাকে উপেক্ষা করার কারণে।
    আমাকে ক্ষমা করো শাওন। আমার জীবনে আর কিছুই প্রয়োজন নেই। শুধু তুমি আমাকে তোমার বক্ষে জড়িয়ে ধরে রাখো। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব।’ তাসফির অনুরোধে বক্ষে জড়িয়ে ধরে দু’জনের কান্নার বেদনাগুলো আনন্দে পরিণত হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় দূরে থেকে কাছে আসার অনুভবের চেয়ে আর কোন কিছুই তৃপ্তির হতে পারেনা।
    = সমাপ্ত =

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ